রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে দিন দিন তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। গত বছর গরমে ভয়ংকর এক এপ্রিল দেখেছে বাংলাদেশ। ওই মাসে দেশের ইতিহাসে ৭৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত টানা ৩৫ দিন তাপপ্রবাহে ধুঁকেছিল মানুষ। এক মাসের তীব্র গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি, শ্রম ও শিল্প উৎপাদন। শুধু তাই নয়, শতাধিক মানুষের মৃত্যুও ঘটে তীব্র গরমে।
আবহাওয়াবিদরা একের পর এক সতর্ক করছেন, তাপমাত্রার হুমকি আরও বাড়বে। গত মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গরমে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য– এ দুইয়ের ক্ষতির ফলে গত বছর বাংলাদেশের মানুষের ২৫ কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। ২১ হাজার কোটি টাকার মতো আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, যা বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ৪ ভাগ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের এক দিন পর তাপপ্রবাহ নিয়ে উঠে এসেছে আরও ভীতিকর চিত্র। গতকাল বুধবার প্রকাশিত আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট সেন্ট্রালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এ বছর অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের একটি বাংলাদেশ। গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে প্রায় ছয় কোটি মানুষ দীর্ঘ সময় মারাত্মক গরমের মুখোমুখি হয়েছে। এই তাপপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সামনে আরও ভয়ংকর সময় অপেক্ষা করছে। প্রকৃতি বিরূপ হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে জলবায়ু পরিবর্তন। তবে এমন দুর্যোগের জন্য শুধু প্রকৃতিকে দায়ী করে যাওয়াটা কোনো বিশেষজ্ঞই সমর্থন করছেন না। তাপপ্রবাহের পেছনে তারা মানুষের ভূমিকা দেখছেন। জলাশয় ধ্বংস থেকে শুরু করে অবিরাম কার্বন নিঃসরণ, নির্বিচারে গাছ কাটা, অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ অনেক কিছুই প্রকৃতিকে রুষ্ট করে তুলছে বলে মনে করেন তারা।
গবেষকরা বলছেন, এই চরম গরম মোকাবিলায় এখনই অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। শহর এলাকায় সবুজায়ন, পানি সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।
ঝুঁকিপূর্ণ তাপমাত্রার শিকার ৩৪ শতাংশ মানুষ
গতকাল প্রকাশিত ক্লাইমেট সেন্ট্রালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঝুঁকিপূর্ণ তাপমাত্রার শিকার মানুষের সংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দশম। দেশে প্রায় ৫৭ মিলিয়ন মানুষ বা মোট জনসংখ্যার ৩৪ শতাংশ ৩০ দিনেরও বেশি সময় ধরে এমন গরম সহ্য করেছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। এর মধ্যে ৩০ মিলিয়ন মানুষ বিশেষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিরিক্ত ৩০ দিন এই ভয়াবহ তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল সমকালকে জানিয়েছে, গত ছয় দশকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। এ ধারা থাকলে আগামী তিন দশকে তাপমাত্রা বাড়ার এই মাত্রা ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের পাঁচ প্রধান নগরের এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ তীব্র গরমে বিপর্যস্ত। নগরগুলো হলো– ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট। এর মধ্যে ঢাকার ৭৮ শতাংশ বা এক কোটি ২৫ লাখ মানুষ এ ঝুঁকিতে রয়েছে। ৯ বছরের কম ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ গরমের কারণে সবচেয়ে বেশি শারীরিক সমস্যায় পড়ছে।
ঢাকার বাইরেও পরিস্থিতি নাজুক
রাজধানী ঢাকার বাইরেও অন্য শহরগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ তাপের দিন বেড়েছে। বিভাগীয় শহরভিত্তিক বিশ্লেষণেও ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। রংপুরে গড়ের চেয়ে ০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা। উত্তরের এই শহরে বছরে ৩৭ দিন ঝুঁকিপূর্ণ গরম, যার মধ্যে ২৪ দিন সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। ঢাকায় ৫২ দিন ঝুঁকিপূর্ণ তাপমাত্রা, যার মধ্যে ১৫ দিন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। চট্টগ্রামে দেশের সর্বোচ্চ ৫৯ দিন ঝুঁকিপূর্ণ তাপমাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা গেছে।
এমন উষ্ণতম দিনের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। বিশেষ করে শিশু, প্রবীণ ও শ্রমজীবী মানুষ বেশি ঝুঁকিতে আছেন। কৃষি উৎপাদন কমছে, ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও পানির চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে, অথচ সরবরাহ সংকটে পড়ছে।
২০২৩ সালের ২৯ মার্চ প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী আরবান ক্লাইমেটে ‘চেঞ্জেস ইন হিউম্যান ডিসকমফোর্ট অ্যান্ড ইটস ড্রাইভার ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ছয় দশকে শুধু ঢাকায় তীব্র এবং অসহনীয় গরমের দিনের সংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে। ১৯৬১ সালে ঢাকায় সারাবছরে আরামদায়ক দিনের সংখ্যা ছিল ৮০। আর প্রচণ্ড গরমে কষ্টকর দিনের সংখ্যা ছিল ৭। ২০২০ সালে আরামদায়ক দিনের সংখ্যা কমে ৬৬ এবং কষ্টকর দিন বেড়ে হয়েছে ২১।
বৈশ্বিক চিত্র
ক্লাইমেট সেন্ট্রালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিকভাবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ২০২৫ সালের জুন থেকে আগস্ট– এই তিন মাসে প্রতিদিন বিশ্বের প্রতি পাঁচজনের একজন বা অন্তত ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তীব্র প্রভাবিত তাপমাত্রার মুখোমুখি হয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্তত দ্বিগুণ সম্ভাবনায় ঘটেছে। প্রায় ৯৫৫ মিলিয়ন মানুষ অন্তত ৩০ দিন অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ গরম সহ্য করেছে। ১৮৩টি দেশের মানুষ অন্তত ৩০ দিন এমন তাপমাত্রার সম্মুখীন হয়েছে।
ক্লাইমেট সেন্ট্রালের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. ক্রিস্টিনা ডাহল প্রতিবেদনে বলেন, এই বিশ্লেষণ নিশ্চিত করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কোনো ভবিষ্যতের হুমকি নয়–এখনকার বাস্তবতা। অস্বাভাবিক গরম ইতোমধ্যেই মানুষের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে যত দেরি হবে, তত বেশি মানুষ, অর্থনীতি ও প্রকৃতি ক্ষতির মুখে পড়বে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দীর্ঘায়িত গরম ইতোমধ্যেই চরম আবহাওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। ইউরোপে ঘটেছে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন অগ্নিকাণ্ড, কানাডায় রেকর্ড সংখ্যক দাবানল, আর যুক্তরাষ্ট্রে দেখা দিয়েছে শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ বন্যা। এমনকি শীতল আবহাওয়ার দেশ ফিনল্যান্ড ও নরওয়েতেও টানা কয়েক দিন মাত্রাতিরিক্ত গরম রেকর্ড করা হয়েছে।
বাংলাদেশে কেন এত উত্তাপ
ঢাকাসহ জেলা শহরে তাপমাত্রা বাড়বাড়ন্ত হওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি অতিরিক্ত জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমি ভরাট ও গাছপালা কেটে ফেলাকেই দায়ী করেছেন গবেষকরা।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয়– এ তিন কারণে তাপমাত্রা বেড়েছে। বৈশ্বিক কারণের মধ্যে রয়েছে– পৃথিবীর ফুসফুস অ্যামাজন ফরেস্ট নষ্ট হওয়া, উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় কার্বন নিঃসরণ ও ফুয়েল বার্ন বেড়ে যাওয়া। এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়ছে। ঢাকাসহ সারাদেশের জেলা শহরে জলাধার বা পুকুরের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। জলাধার মাটির বদলে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। এটিও তাপমাত্রা বাড়ার অন্যতম কারণ। ঢাকা নগরের বর্তমান জনসংখ্যা দুই কোটিরও বেশি, যেটি প্রত্যক্ষভাবে তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এখন ভবনগুলোর নকশাই হচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসানোর ব্যবস্থা রেখে। অথচ আগে অনেক ভবন এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে গরমকালে শুধু পাখাতেই কাজ হতো। ভবনগুলোর চারদিকে খালি জায়গা এবং এলাকাভিত্তিক জলাধার রাখতে পারলে তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে জলবায়ু নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে, বিশেষ করে মেট্রোরেলের মতো বিদ্যুৎচালিত গণপরিবহন বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণ করতেই হবে।
সমুদ্রবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, বাংলাদেশের মানুষের এখন বাড়তে থাকা তাপমাত্রার সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার সময় এসে গেছে। তাপপ্রবাহকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা, নীতি ও বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রতিবছর তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। তাপপ্রবাহ আগাম সতর্ক সংকেত ব্যবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন। এলাকা ও সময়ভিত্তিক তাপপ্রবাহের সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দিতে হবে। কোন কোন এলাকায় তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে, তাপমাত্রা কত ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে যাবে– এসব তথ্য দিয়ে দায় সারলে হবে না। ওই তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় আমাদের কী করতে হবে, কীভাবে এবং কারা তা করবে, সেই ব্যবস্থাপনাও রাখতে হবে। এককভাবে, সরকারি কোনো সংস্থার অল্প জনবল নিয়ে এ ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা করা কঠিন। তাই সরকারি-বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনায় তা কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে হবে। সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। করণীয় তালিকা বেশ দীর্ঘ নয়। এককথায় বললে সচেতনতা, আন্তরিকতা এবং পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
এ ব্যাপারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তাপদাহ মোকাবিলায় আমাদের নগর পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করতে হবে– কম কংক্রিট, বেশি সবুজায়ন, কার্যকর গণপরিবহন, ছাদবাগান এবং ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি। সিটি করপোরেশনগুলো ইতোমধ্যে ব্যাপক সবুজায়ন কার্যক্রম শুরু করেছে, তবে এ উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত করা প্রয়োজন।